জাতি হিসেবে বাঙালির আবির্ভাব

 
জাতি হিসেবে বাঙালির আবির্ভাব
বাংগালী জাতী


জাতি হিসেবে বাঙালির আবির্ভাব


প্রথম দিকে ইলিয়াস শাহ্ লখনৌতি বা লক্ষ্মণাবতীর শাসক হিসেবে আবির্ভূত হন। পরে তিনি লখনৌতি ও বাঙ্গালাকে চু -কতৃত্বাধীনে আনায়ন করেন এবং উভয় দেশকে একত্রিত করে বাঙ্গালা নামে অভিহিত করেন।

 এ সম্মিলিত বাঙালি নামে পরিচিত। ইলিয়াস শাহ্ নিজেকে বঙ্গের স্বাধীন ও সার্বভৌম সুলতান হিসেবে এবং বাঙালিদের জাতীয় শাহর হিসেবে ঘোষণা করেন।

 এতে দুই ভূ-খণ্ডের স্বাতন্ত্র্য যেমন বিলুপ্ত হলো, তেমনি বাঙ্গালা বা বঙ্গ নামটি এককভাবে আত্মহ করল। তাঁর এ অর্থও ভৌগোলিক রাষ্ট্রীয় ঐক্যসমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠার পশ্চাতে বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও ছিল। 

বাঙ্গালার এক বি অংশে তখনো হিন্দু শাসকগণ রাজত্ব করতেন। তাঁরা নিজেদের 'গৌড়েশ্বর' হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করতেন।

 নি কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে এতদঞ্চলের নেতৃবর্গ ও জনগণের সাহায্য ও সমর্থন ইলিয়াস শাহের প্রয়োজন ছিল এ কারণে বাঙালি অধ্যুষিত সকল অঞ্চলকে তিনি বাঙ্গালা নামে অভিহিত করেন এবং নিজেকে বৃহত্তর বাঙ্গালার জাতীয় নেতৃ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হন।

 বাঙ্গালার সাথে নিজের অভিন্নতা প্রকাশের জন্য তিনি 'শাহ-ই-বাঙ্গালা' এবং শহর বাঙালি’ উপাধি গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর সেনাপতি ও সেনাবাহিনীর নামকরণ করেছিলেন 'রেয়ান-ই-বাঙ্গালা', 'লম্বর) বাঙ্গালা' ও 'পাইকান-ই-বাঙ্গালা'।


আরও পড়ুন, 

বাংলাদেশের সংবিধান  

সমাজ গঠনের উপাদান  

একজন নাগরিকের অধিকার 

সামাজিক বিজ্ঞান  


প্রথমবঙ্গ-গঠন :

ইলিয়াস শাহই প্রথম বাঙালি অধ্যুষিত সকল অঞ্চলের সমন্বয়ে বাঙ্গালা বা বঙ্গ গঠন করেন যার সীমানা ছিল তেলিয়াগড়ি থেকে চট্টগ্রাম এবং হিমালয়ের পাদদেশ থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত। এ সময় থেকেই বঙ্গদেশ ও বাঙালি জাতির নবর ইতিহাসের যাত্রা শুরু।


সুৰা বাংলা:

 মুসলিম শাসনামলেই বাঙ্গালা এবং বাঙালির সুনির্দিষ্ট অস্তিত্ব প্রথম আত্মপ্রকাশ করে। পরবর্তীকালের বিভিন্ন লেখকের রচনায় ও শাসকের বর্ণনায় আমরা যে বাঙালি ও বাঙ্গালার উল্লেখ লক্ষ্য করি, ইলিয়াস শাহই তাঁর পথপ্রদর্শক ছিলেন। কালের পরিবর্তন ও রাজনৈতিক উত্থান-পতনের কারণে বঙ্গের সীমারেখার পরিবর্তন ঘটেছে সত্যি, কিন্তু বাঙ্গাল ও বাঙালির ঐতিহ্য কখনো নিষ্প্রভ হয়নি। মুঘল সম্রাট আকবর রাজমহল দখলের পর বাঙ্গালা বা বঙ্গকে একটি সুবায় পরিণত করেন। এ সময়ে একে বলা হত 'সুবা বাংলা'। ষোড়শ-সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের পাশ্চাত্যের বণিকদের দলিলপত্রে বঙ্গকে 'বেঙ্গালা' (Bengala বা [Bengalla) নামে উল্লেখ করা হয়েছে।


বেঙ্গল:

 ইংরেজ বণিকরাই সর্বপ্রথম বাংলা বা বঙ্গকে ‘বেঙ্গল' (Bengal) নামে অভিহিত করে। ইংরেজ শাসনামলে 'বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী' বলতে বর্তমান বাংলাদেশ, পশ্চিম বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যাকে বুঝাত। পরে শুধু বাংলাভাষীদের সমন্বয়ে বাংলা প্রদেশ গঠিত হয়েছিল।


বাংলাদেশ : 

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হলে বাঙালি মুসলমান অধ্যুষিত এলাক পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। তখন পূর্ব বাংলার নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে। নব্য স্বাধীন এ ভূ-খণ্ড 'বাংলাদেশ' নাম গ্রহণ করে। বাংলাদেশের উত্তরে পশ্চিমবঙ্গ (ভারত), দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা রাজ্য ও বার্মা এবং পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। আয়তনে ১,৪৩,৯৯৮, ২৬ বর্গ কিঃ মিঃ। লোকসংখ্যা প্রায় ১২ কোটি। আয়তনের তুলনায় এর লোকসংখ্যা বেশি। লোকসংখ্যার দিক দিয়ে বিচার করলে বাংলাদেশ মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ।


মধ্যযুগের বাঙ্গালা আর বর্তমানের বাংলাদেশ-এ দুয়ের মধ্যে সময়রেখা যেমন সুদীর্ঘ, রাষ্ট্রীয় সীমারেখাও তেমনি অভিন্ন নয়। এতদসত্ত্বেও এ দুই নামের মধ্যে একটি অদৃশ্য অথচ অভিন্ন সংযোগ অনুভব করা যায়।

 মধ্যযুগের বাঙ্গালা গড়ে উঠেছিল মুসলমান শাসনামলে, আজকের বাংলাদেশও মুসলিম বাঙালিদেরই সংগ্রামের ফল। বর্তমান বাংলাদেশ নামকরণের মধ্যে অতীতের বাঙ্গালা বা বঙ্গের স্মৃতিই তাই দেদীপ্যমান।


প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগের বাংলার ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে স্বভাবতই লক্ষ্য করা যায় যে, অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, ঘটনা-প্রবাহ, রাজনৈতিক জয়-পরাজয় ও ভৌগোলিক পরিবর্তন-বিবর্তনকে

 বক্ষে ধারণ করে 'বাংলা' নামক ভূ-খণ্ডটি আপন অস্তিত্বের ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছে। তাই বিভিন্ন রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ও আয়তনের হ্রাস-বৃদ্ধি সত্ত্বেও 'বাংলা' ইতিহাসের এক অক্ষয় নাম।


সাধারণত দেখা যায় একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে জাতি ও ভাষাগত ঐক্য গড়ে ওঠে এবং বিকাশ লাভ করে। প্রাচীন বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। 

কালে কালে, যুগে যুগে বিভিন্ন পরিস্থিতি এবং পরিবেশের প্রভাবে বাঙালি জাতি তার ভাষা, সংস্কৃতি ও স্বাতন্ত্র্য নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল। নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক আবেষ্টনীর মধ্যে বাঙালি জাতির এ আপন বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠেছিল। 

এ ভূ-খণ্ডের ইতিহাস জানতে হলে তাই এর প্রাকৃতিক বেষ্টনী বা ভৌগোলিক। সীমারেখাকে অস্বীকার করা যায় না। ভৌগোলিক দিক থেকে বঙ্গদেশ উত্তর ভারতের প্রত্যন্ত প্রদেশ বলে এখানে বিদেশীদের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ প্রসারিত হয়নি।

 মধ্যযুগেও বাংলার ভৌগোলিক বেষ্টনী ও ভিন্নধর্মী আবহাওয়ার দরুন দিল্লীর শাসকগণ সহজে এখানে আক্রমণ চালাতে সাহসী হতেন না। এ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বঙ্গদেশ অনেকবার দিল্লীর শাসকবর্গের বি বিদ্রোহী হয়েছে। এ কারণে বাংলার আরেক নাম ছিল 'বুলঘকপুর' (বিদ্রোহের দেশ)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন