শবে বরাতের ফজিলত ও গুরুত্ব

শবে বরাতের ফজিলত 

শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কে  কোরআন মাজিদে সরাসরি নির্দেশনা না থাকলেও হাদিস শরিফে নির্ভরযোগ্য সনদ বা বর্ণনাসূত্রে একাধিক হাদিস বর্ণিত  হয়েছে। আজকে আমরা তাই তুলে ধরবো। 


শবে বরাতের ফজিলত ও গুরুত্ব
শবে বরাত 


শবে বরাত কি

শাবান মাসের চৌদ্দ তারিখ দিবা গত রাতকে শবে বরাত বলে। শব অর্থ- রাতি, আর বরাত অর্থ-অদৃষ্ট বা ভাগ্য। সুতরাং শবে বরাত অর্থ- ভাগ্য রজনি। শবে বরাত দুনিয়ার সমস্ত মুসলমানের নিকট অতি পরিচিত গুরুত্বপূর্ণ একটি রাত। 


শবে বরাতের ফজিলত


শবে বরাতের গুরুত্ব 

এ রাতে বান্দার ভাল-মন্দ, রুজী-রোজগার, হায়াত মণ্ডত প্রভৃতি যাবতীয় বিষয় লিপিবদ্ধ করা হয়।উল্লেখিত কারণেই মানুষের কাছে শবে বরাতের গুরুত্ব অপরিসীম।


শবে বরাতের ফজিলত 

 সারা বসরে একমাত্র শবে কদর ব্যতীত এত অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও মাহাত্ম মণ্ডিত রাত আর দ্বিতীয়টি নেই। এ মাহাত্ম ও গুরুত্বের কারণেই মহান আল্লাহ পাক এ রাতটিকে অফুরন্ত ফযীলত দান করেছেন। 


শবে বরাত সম্পর্কে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত আছে। এখানে তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হাদীস বর্ণনা করা হল


শবে বরাতের ফজিলত


ইমাম সুককী (রহঃ) তদীয় তফসীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, জুমআর রাতের ইবাদতের উসিলায় সপ্তহের গোনাহ মাফ হয় এবং শবে বরাতে ইবাদত করলে সারা জীবনের গোনাহ্ মাফ হয়ে যায়।


 এ জন্য শবে বরাতকে গোনাহ মাফীর রাতও বলা হয়। অনুরূপ এরাতকে হায়াত বা জীবনের রাতও বলা হয়। ইমাম মুনযেরী (রহঃ) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে ছাদীস বর্ণনা করেছেন- যে ব্যক্তি দু' ঈদের দুই রাত এবং অর্ধ শাবানের রাত জেগে ইবাদাত করবে, তার অন্তর কিয়ামতের দিন মরবেনা যে দিন অন্তরসমূহের মৃত্যু হবে।


এ রাতকে শাফাআতের রাতও বলা হয়। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের জন্য তেরই শাবানের রাতে সুপারিশ করেছিলেন, তাতে এক তৃতীয়াংশ কবুল হয়েছিল।


শবে বরাতের ফজিলত


 আতঃপর চৌদ্দই শাবানের রাতে সুপারিশ করেছেন, তাতে কবুল হয়েছে আরেক তৃতীয়াংশ, আতঃপর পনেরই শাবানের রাতের সুপারিশে অবশিষ্ট তৃতীয়াংশ কবুল হয়ে তা পূর্ণতা লাভ করে।শবে বরাতের এ রাতকে মাগফেরাতের রাতও বলা হয়। 


ইমাম আহমদ (রহঃ) বর্ণনা করেছেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন-“আল্লাহ তা'য়ালা অর্থ শাবানের রাতে বান্দদের প্রতি বিশেষ করুণার দৃষ্টি করেন এবং দু' শ্রেণীর লোক ব্যতীত সকলের মাগফিরাত করে দেন। এ দুই শ্রেণী হল, মুশরিক ও হিংসুক।


শবে বরাতের রাতের সন্ধ্যায় গোসল করা মুস্তাহাব। যদি কেউ এ রাতে গোসল করে, তবে শরীরের ছিটকানো প্রত্যেক পানির ফোঁটার পরিবর্তে তার আমলনামায় মহান আল্লাহ পাক সাতশ রাকাত নফল নামাযের সওয়াব দান করেন। 


শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কে হাদিস সমূহ


নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক হাদীসে বলেছেন - طوبى لمن يعمل في ليلة النصف من شعبان


অর্থঃ সেই ব্যক্তির জন্য পরম সৌভাগ্য এবং খুশির কথা, যে শাবান মাসের পনের তারিখ রাতে ইবাদাতে লিপ্ত থাকে।


হযরত আবু বকর (রাঃ) বলেছেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন যে, হে মুমিনগণ! তোমরা শাবান মাসের পনের তারিখ রাত জেগে ইবাদাত বন্দেগী কর ।


শবে বরাতের ফজিলত

কেননা ঐ রাতটি অতিশয় বরকতময় এবং ফযীলতপূর্ণ। এ রাতে মহান আল্লাহ তা'য়ালা বলে থাকেন, হে বান্দাগণ! তোমাদের মধ্যে ক্ষমা প্রার্থনাকারী কেউ আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। এসম্পর্কে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন


إن الله يا أرحم عصاء أمتي في ليلة النصف من شعبان بعد شعور A انعام بنی کلب و بني ربيع ومضرا


অর্থঃ “নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক এ রাতে বনী কালব, বনী রবী এবং বনী মুদার গোত্রের সমগ্র ভেড়া বকরীর পশমের সংখ্যার পরিমাণ আমার গুনাহগার উম্মতকে ক্ষমা করে থাকেন।


উল্লেখ্য যে, আরবের এ তিনটি গোত্রের প্রত্যেক গোত্রে তখন কম বেশি তিন হাজার হতে বিশ হাজার করে ভেড়া ও বকরী ছিল।


অপর এক হাদীসে বর্ণিত আছে যে, হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, জিব্রাইল ফেরেশতা এসে আমাকে বলে গেলেন যে, আপনার উম্মতগণকে জানিয়ে দিন যে, তারা যদি শবে বরাতে


 ইবাদাত করে, তবে তারা যেন শবে কদরে ইবাদাত করল। এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, শবে বরাতের ইবাদাত শবে কদরের ইবাদাতের মতই মূল্যবান।


আরেক হাদীসে বর্ণিত আছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- "এ রাতে যারা ইবাদতে মগ্ন থাকে তাদের প্রতি মহান আল্লাহর ফেরেশতাগণ অবতীর্ণ হয়। তাদের সগীরা কবীরা গোনাহসমূহ মহান আল্লাহ পাক ক্ষমা করে থাকেন।”


অপর এক হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- “জিব্রাইল ফেরেশতা এসে আমাকে বলে গেলেন যে, হে আল্লাহর নবী! আপনি উঠে নামায পড়ুন এবং মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করুন।


 কারণ এ রাতে মহান আল্লাহ পাক তাঁর বান্দার জন্য একশত রহমতের দরজা খুলে দেন। অতএব আপনি আপনার গুনাহগার উম্মতদের অপরাধ ক্ষমা করে নিন।


 অবশ্য মুশরিক, যাদুকর, গণক, কৃপণ, সুদখোর, শরাব পায়ী ও ব্যভিচারীদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন না। কারণ তাদেরকে আল্লাহ অবশ্যই শাস্তি প্রদান করবেন।


অন্য এক হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন- শাবান মাসের শবে বরাতের রাতে যে ব্যক্তি একশত রাকাত নফল নামায আদায় করবে, তার জীবনের যাবতীয় গোনাহ ক্ষমা করা হবে এবং তার জন্য দোজখ হারাম হয়ে যাবে।


নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অপর এক হাদীসে বলেছেন- শবে বরাতের রাতকে যে জিবিত রাখে অর্থাৎ ইবাদাত বন্দেগী করে, মহান আল্লাহ পাক তাকেও জীবিত রাখবেন। অর্থাৎ তার আমল নামায় মৃত্যুর পরেও কিয়ামত পর্যন্ত সওয়াব লিখা হতে থাকবে।


অপর এক হাদীসে বর্ণিত আছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন- মহান আল্লাহ তা'য়ালা স্বীয় বান্দাদেরকে লক্ষ্য করে কলতে থাকেন,আজ যেই বান্দা আমার সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা করবে, আমি তাকে ক্ষমাদান করব।


 যে আজ আমার কাছে সুস্বাস্থ্য কামনা করবে, আমি তাকে আজ তা দান করব। যে আজ আমার নিকট ধন-সম্পদ প্রার্থনা করবে, আমি তাকে অপরিমিত ধন-সম্পদ দান করব। তাকে ধনশালী বানাব।


উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়শা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, আমি এক রাতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট গেলাম। তখন তিনি উঠে জায়নামাযে চলে গেলেন। 


এতে আমার মনে হল এটা আমার প্রতি তার অবজ্ঞা। যখন দেখলাম নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সিজদায় গিয়ে কাদছেন, আর উম্মতের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেছেন। 


তখন আমি বললাম, আল্লাহর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমার পিতা মাতা আপনার জন্য কোরবান হোক। আপনি সেজদায় পড়ে কাদছেন আর আমি অবহেলিত ভাবে দাড়িয়ে আছি।


 নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সিজদা হতে মাথা উঠায়ে বললেন- হোমায়রা! (নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আয়েশা (রাঃ) কে আদরের সাথে এ নামে ডাকতেন) তুমি কি জান আজ কোন রাত?


 হযরত আয়েশা (রাঃ) বললেন- আল্লাহর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ সম্পর্কে ভাল জানেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- আজ শাবান মাসের পনের তারিখ রাত।


 এটা এমন এক রাত, যে রাতে মহান আল্লাহর নিকট কোন কিছু প্রার্থনা করলে তা কবুল হয়। যদি কারও গোনাহ পাহাড় সমানও হয়, তবু তা এ রাতে ক্ষমা করা হয়।


উল্লেখ্য বিষয় হলো শবে বরাতের কোনো নির্দিষ্ট নামাজ কিংবা আমলের কথা কুরআন ও হাদিসের কোথাও নেই।তবে এ রাতে বেশি বেশি ইস্তিগফার করা, আল্লাহর কাছে স্বীয় গোনাহের মাফীর জন্য কান্নাকাটি করা, দুআ করা, কুরআন তিলাওয়াত করা,নফল নামায পড়া, জিকির করা ইত্যাদী ইবাদত করা উত্তম ও ফযীলতপূর্ণ।


এই শবে বরাত নিয়ে আমাদের মাঝে কিছু কুসংস্কার প্রচলিত আছে।তার মধ্যে একটি  কুসংস্কার হল হালুয়া রুটি।অনেকেই আবার মনে করেন হালুয়া রুটি ছাড়া শবে বরাত হয় নাহ।


এটাও শয়তানের এক প্রকার সূক্ষ্ম কারসাজি। হালুয়া-মিষ্টি রুটির চক্করে ফেলে দিয়ে মুসলমানদের ইবাদত করা থেকে দূরে রাখাই তার উদ্দেশ্য।


সুতরাং শবে বরাতের রাতে বেশি বেশি নফল ইবাদত করবো। ইসলাম বহির্ভুত কোন কাজ করবো না। আমরা বিদাত মুক্ত আমল করবো। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন