আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু

আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু নিয়ে আমরা অনেক স্বপ্ন দেখেছি।আমাদের সেই স্বপ্ন পূরন এখন অনেকটাই বাস্তব। এই স্বপ্ন পূরনে অনেক কাজ করেছেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

স্বপ্নের পদ্মা সেতু | পদ্মা সেতু

স্বপ্নের পদ্মা সেতু | পদ্মা সেতু




স্বপ্ন ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নির্বাচনি ইশতেহারে যমুনা, বুড়িগঙ্গা, কর্ণফুলী, শীতলক্ষ্যা নদীর উপরে সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিলেও, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু পদ্মা নদীর উপর সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। 


কিন্তু ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ায় পদ্মা সেতুর স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।


অনেক চড়াই-উতরাইয়ের পর পূর্ণ অবয়ব পেয়েছে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্নের সেতুর মূল কাঠামো, যুক্ত হয়েছে পদ্মার দুই তীর। ১০ই ডিসেম্বর ২০২০, বৃহস্পতিবার বেলা ১২টা ২ মিনিটে পদ্মা সেতুর টু-এফ নম্বর স্প্যানটি বসানো হয় মাওয়া প্রান্তের ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটির ওপর।


 যে ৪১টি স্প্যান বসিয়ে পুরো সেতু তৈরি হচ্ছে, এটি ছিল তার সর্বশেষ। এই স্প্যানটি বসানোর মধ্য দিয়েই সেতুর মূল কাঠামোর পুরোটা দৃশ্যমান হলো। স্বপ্ন সত্যি হলো। দিনের আলোয় চোখের সামনে ধরা দিল পদ্মা সেতু। এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হলো বাংলাদেশ, পুরো বিশ্ব।


সর্বশেষ স্প্যানটি বসানোর মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতুর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বড়ো কাজের সমাপ্তি হলো। এরপর সড়ক ও রেলের স্ল্যাব বসানো সম্পন্ন হলে সেতু দিয়ে যানবাহন ও ট্রেন চলাচল করতে পারবে। এতে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২৯ জেলার সঙ্গে সারা দেশের সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হওয়ার পথ উন্মুক্ত হবে।


 পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যানটি খুঁটির ওপর বসেছিল ২০১৭ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর। বাকি ৪০টি স্প্যান বসাতে তিন বছর দুই মাস লাগল। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি এবং বন্যার অত্যধিক স্রোত পদ্মা সেতুর কাজে কিছুটা গতি কমিয়ে দিয়েছিল । 


তবে গত ১১ই অক্টোবর, ২০২০ ৩২তম স্প্যান বসানোর পর অনুকূল আবহাওয়া পাওয়া যায়। কারিগরি কোনো জটিলতাও তৈরি হয়নি। ফলে টানা বাকি স্প্যান গুলো বসানো সম্ভব হয়। 


সাধারণত সেতু স্টিলের অথবা কংক্রিটের হয়। কিন্তু পদ্মা সেতুটি হচ্ছে স্টিল ও কংক্রিটের মিশ্রণে। সেতুর মূল কাঠামোটা স্টিলের, যা স্প্যান হিসেবে পরিচিত। খুঁটি এবং যানবাহন চলাচলের পথ কংক্রিটের।


পদ্মার মূল সেতু, অর্থাৎ নদীর অংশের দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। অবশ্য দুই পারে আরও প্রায় চার কিলোমিটার সেতু আগেই নির্মাণ হয়ে গেছে। এটাকে বলা হয় ভায়াডাক্ট। এর মধ্যে স্টিলের কোনো স্প্যান নেই। দ্বিতলবিশিষ্ট পদ্মা সেতুর স্টিলের স্প্যানের ওপর দিয়ে চলবে যানবাহন। 


এই পথ তৈরির জন্য কংক্রিটের স্ল্যাব বসানোর কাজ চলছে। সম্পন্ন হয়ে গেলে পিচঢালাই করা হবে। পুরো কাজ শেষ হলে যানবাহন চলাচলের পথটি হবে ২২ মিটার চওড়া এবং চারলেনের। মাঝখানে থাকবে বিভাজক। 


স্প্যানের ভেতর দিয়ে চলবে ট্রেন। সেতুতে একটি রেললাইনও থাকবে। তবে এর ওপর দিয়ে মিটারগেজ ও ব্রডগেজ দুই ধরনের ট্রেন চলাচলেরই ব্যবস্থা থাকবে। ভায়াডাক্টে এসে যানবাহন ও ট্রেনের পথ আলাদা হয়ে মাটিতে মিশবে ।


২০১৪ সালের নভেম্বরে মূল সেতুর কাজ শুরু হয়। অবশ্য জমি অধিগ্রহণ, সংযোগ সড়ক নির্মাণ, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন ও অবকাঠামো নির্মাণের কাজ এর আগেই শুরু হয়েছিল । মূল সেতু ও নদীশাসনের কাজ শুরুর পর অবশ্য নানা চ্যালেঞ্জ এসেছে।


কখনো পদ্মার ভাঙন, আবার কখনো কারিগরি জটিলতায় কাজ আটকে গেছে। পরিবর্তন করতে হয়েছে নকশায়। কিন্তু কাজ থেমে থাকেনি।


২০১৫ সালের ১২ই ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হসিনা মূল সেতুর নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। সেদিন তিনি বলেন, বড়ো কাজ করতে গেলে ‘হাত পাততে হবে’ এ মানসিকতা ভাঙতেই নিজস্ব অর্থায়নে


 দেশের সবচেয়ে বড়ো এই অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি চেয়েছিলাম, আমরা পারি, আমরা তা দেখাব। আজ আমরা সেই দিনটিতে এসে পৌঁছেছি। বাঙালি জাতি কারও কাছে মাথা নত করেনি, করবেও না।'


পদ্মা সেতু নির্মাণে ছিল বাধা, অর্থের সংস্থান নিয়েও অনিশ্চয়তা, দুর্নীতির ষড়যন্ত্র, বিশ্বব্যাংকের ঋণ প্রস্তাব বাতিল, দেশে-বিদেশে সমালোচনা। এসবের পাশাপাশি ছিল প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জও। তবে এত জটিলতার বিপরীতে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছিল তাঁর নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস। সবকিছু উপেক্ষা


করে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে তাঁর স্বপ্ন এবং চ্যালেঞ্জের বাস্তবায়ন করেছেন। বাংলাদেশের এ অর্জন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তা, দূরদর্শী নেতৃত্বের সাক্ষ্য বহন করে। 


দেশের মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু শুধু মাত্র একটি অবকাঠামো নয়, এটা দেশের মানে আমাদের আত্মবিশ্বাস, আত্মসম্মান সক্ষমতা আর আত্মমর্যাদার প্রতীক। বাঙালির গর্বের আরেকটা নতুন সংযোজন।

স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মিত হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব নিয়ে সেতুর ডিজাইন পরামর্শক এক বিশ্লেষণে বা স্টাডি রিপোর্টে সেতুর বেনিফিট-কস্ট রেশিও (বিসিআর) ১ দশমিক ৭ এবং ইকোনমিক ইন্টারনাল রেট অব রিটার্ন (ইআইআরআর) ১৮ শতাংশ উল্লেখ করেন। 


তাছাড়া সেতু নির্মাণ ব্যয় যুক্ত হয়ে বিসিআর ২ দশমিক ১ এবং ইআইআরআর দাঁড়াবে ২২ শতাংশ। এর অর্থ হলো, এ সেতু নির্মাণ অর্থনৈতিক বিবেচনায় লাভজনক হবে। দক্ষিণাঞ্চলের ২৯টি জেলার সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ দূরত্ব ২ থেকে ৪ ঘণ্টা কমে যাবে। এছাড়া 

  • ব্যবসা-বাণিজ্য, নানা শিল্প গড়ে উঠবে,
  • বার্ষিক জিডিপি ২ শতাংশ এবং দেশের সার্বিক জিডিপি ১ শতাংশের অধিক হারে বাড়বে,
  • ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সংযোগ স্থাপিত হবে।
  • মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর সচল হবে পর্যটনশিল্পের প্রসার ঘটবে এবং দক্ষিণ বাংলার কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, সুন্দরবন, ষাট গম্বুজ মসজিদ, টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজার, মাওয়া ও জাজিরা পাড় দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদভারে মুখরিত হবে।



এক নজরে পদ্মা সেতু

  • পদ্মা সেতুর প্রকল্পের নাম- পদ্মা বহুমুখী সেতু
  • প্রকল্প ধরন- দ্বিতলাবিশিষ্ট
  • নির্মাণ সামগ্রী- কংক্রিট ও স্টিল
  • চুক্তিবদ্ধ কোম্পানির নাম- চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি
  • দৈর্ঘ্য- ৬.১৫ কিলোমিটার, তবে ডাঙার অংশ ধরলে এর দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় প্রায় ৯ কিলোমিটার।
  • প্রস্থ- চারলেন সড়কের সেতুটির প্রস্থ ৭২ ফুট। মাঝখানে রোড ডিভাইডার
  • নদীশাসন দুই প্রান্তে- ১২ কিলোমিটার
  • সংযোগ সড়কের দৈর্ঘ্য- মাওয়া প্রান্ত ১৮ কিলোমিটার, জাজিরা প্রান্ত ১৪ কিলোমিটার
  • ভায়াডাক্টের দৈর্ঘ্য- ৩.১৮ কিলোমিটার 
  • ভায়াডাক্ট পিলার- ৮১টি
  • পাইলিং গভীরতা- ৩৮৩ ফুট
  • পানির স্তর থেকে পদ্মা সেতুর উচ্চতা- ৬০ ফুট। পানির উচ্চতা যতই বাড়ুক না কেন, এর নিচ দিয়ে পাঁচতলার সমান উচ্চতার যে-কোনো নৌযান সহজেই চলাচল করতে পারবে
  • প্রতি পিলারের জন্য পাইলিং- ৬টি। তবে মাটি জটিলতার কারণে ২২টি পিলারের পাইলিং হয়েছে ৭টি করে
  • পদ্মা সেতুর মোট পাইলিং সংখ্যা- ২৬৪টি
  • পদ্মা সেতুর পিলার সংখ্যা- ৪২টি
  • স্প্যান বসেছে ১১৬৭ দিনে ৪১টি। প্রতিটি প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। ৪২টি খুঁটির সঙ্গে স্প্যানগুলো জোড়া দেওয়ার মাধ্যমে পুরো সেতু দৃশ্যমান হয়েছে
  • একক রেললাইন স্থাপন করা হবে- নিচতলায় সেতুতে রেলপথ সংযুক্তির সিদ্ধান্ত হয়- ২০১১ সালের ১১ ই জানুয়ারি
  • প্রকল্পে মোট ব্যয়- ৩০ হাজার ১৯৩.৩৯ কোটি টাকা 
  • ৪ঠা ২০২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যয় করা হয়েছে- ২৪ হাজার ১১৫.০২ কোটি টাকা
  • নদীশাসন ব্যয়- ৮ হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা
  • রেল ছাড়াও আরও রয়েছে- গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অপটিক্যাল ফাইবার লাইন পরিবহন সুবিধা
  •  রাজধানী ঢাকার সাথে সংযোগ স্থাপন করবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২৯টি জেলার
  • পদ্মা সেতু সংযোগ স্থাপন করেছে- মুন্সিগঞ্জের
  • মাওয়ায় ও শরীয়তপুরের জাজিরায় কাজ শুরু হয়- ৭ই ডিসেম্বর, ২০১৪ সালে
  • পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যান বসানো হয়- ২০১৭ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর


আমাদের দেশের মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু শুধু মাত্র একটি সেতু নয়, এটা দেশের মানে আমাদের আত্মবিশ্বাস, আত্মসম্মান সক্ষমতা আর আত্মমর্যাদার প্রতীক। বাঙালির গর্বের আরেকটা নতুন সংযোজন সৃষ্টি হলো।  

লেখা সংগৃহীত




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন