ইসলামি পরিবার বা আদর্শ পরিবার

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। 

আসসালামু আলাইকুম ওয়ারহমতুল্লাহ।

ইসলামি পরিবার 


ইসলামি পরিবার বা আদর্শ পরিবারঃ-

 আদর্শ পরিবার:

 যে পরিবার ইসলামী আদর্শ ও মূল্যবােধের
ভিত্তিতে গড়ে ওঠে এবং ইসলামী বিধি-বিধানের বাস্তব প্রতিফলন ঘটায় এবং যে পরিবারের সকল সদস্যই মুসলমান হয় তখন তাকে ইসলামী পরিবার হিসেবে গণ্য করা হয়। ইসলামী পরিবারের অপর নাম আদর্শ পরিবার।

আদর্শ ইসলামী পরিবারের বৈশিষ্ট :

১) আদর্শ পরিবার আল্লাহ তা'আলার বিধি-নির্দেশেরই বহি:প্রকাশ : 

আল্লাহ তায়ালা এ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি প্রাণী ও বস্তুই জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। তিনি
পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদম ও হাওয়াকে সৃষ্টি করে প্রথমে জান্নাতে এবং পরে
পৃথিবীতে পরিবারভুক্ত জীবন যাপন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, সে থেকে মানুষ
পরিবারভুক্ত জীবন যাপন করে আসছে। আর এ পরিবার গড়ে ওঠে বিয়ে ও দাম্পত্য
জীবনের মাধ্যমে। যা প্রকৃতির এক চিরস্থায়ী বিধান।

২) তাওহীদ বা একত্ববাদের লালন কেন্দ্রে : 

ইসলামী পরিবার তাওহীদের লালন
কেন্দ্ররূপে গড়ে ওঠতে হবে। একজন শিশু যখন করা বলার চেষ্টা করে তখন তাকে সর্ব
প্রথম আল্লাহ তা'আলার একত্ববাদের বাণী শিখিয়ে দিতে হয়। যাতে তার প্রথম কথায় আল্লাহর একত্ববাদ, তার স্বত্ত্বা ও গুণাবলীর প্রকাশ ঘটে। শিশুকথার ভিত্তি যলি আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্ববাদের ধারণার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় তা হলে তার মধ্যে ইসলামী
আদর্শপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার আশা করা যায় ।

৩) বিশ্ব প্রকৃতির শাশ্বতরূপ : 

বিয়ে ও দাম্পত্য জীবন বিশ্ব প্রকৃতির এক
স্বভাবসম্মত বিধান। এটা এক চিরন্তন ও শাশ্বত ব্যবস্থা- যা কার্যকর রয়েছে বিশ্ব প্রকৃতির
পরতে পরতে প্রতিটি জীব ও জর মধ্যেও। কুরআনের ঘােষণা,

و من كل شيئ لنا وجين لعلكم تذكرون .

“প্রত্যেকটি বস্তুকেই আমি জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি, যাতে তােমরা হৃদয়ঙ্গম
করতে পার।" (আল-যারিয়াত :৪৯)

৪) আদর্শ পরিবার সুখ-শান্তি ও কেন্দ্রস্থল : 

আপন ও প্রিয়জন নিয়ে মিলেমিশে বসবাস করার মধ্যেই রয়েছে সুখ-শান্তি, আনন্দ-তৃপ্তি ও দুঃচিন্তাহীন জীবন
যাপনের মধ্যদিয়ে আদর্শ পরিবারের বিকাশ ঘটে। এ কারণেই মানুষ আদিকাল হতে ইসমাজভুক্ত পারিবারিক জীবনে অভ্যস্ত। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

خلق لكم من أنفسكم أزواجا لگوا اليها و جعل بينكم مودة و رحمة

“তােমাদের জন্য তােমাদের স্বজাতীয়দের মধ্য থেকে জুড়ি সৃষ্টি করেছেন । যেন
তারা তাদের কাছে পরম শান্তি-স্বস্তি লাভ করতে পারে এবং তােমাদের পরস্পরের মধ্যে
গভীর বন্ধুত্ব ও দয়া অনুকম্পও জাগিয়ে দিয়েছেন।” (আর রূম :২১)

৫) পরিবার একটি শিক্ষাকেন্দ্র :

পারিবারিক জীবনে ছােট-বড় সকল সদস্যের নৈতিক চরিত্র গঠন ও উল্কর্ষ সাধনের এক বিশেষ সুযােগ রয়েছে। সন্তানকে আদর্শ
মানুষরূপে গড়ে তােলার এটাই হলাে শ্রেষ্ঠ শিক্ষায়তন। তাই ইসলাম পারিবারিক জীবনের প্রতি উৎসাহিত করে থাকে এবং সদস্যদের নৈতিক চরিত্র গঠনের উপর
গুরুত্বারােপ করে। আল-কুরআনের ঘােষিত হয়েছে,

ايها بين امنوا قوا اشكم و أهليكم نارا۔

“ওহে যারা ঈমান এনেছো! তােমরা নিজেদেরকে এবং তােমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও।" (আত তাহরীম :৬)

৬) পারস্পরিক দায়িত্ববােধঃ

মুসলিম পরিবারের প্রত্যেক সদস্যেরই যথারীতি
দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। আর প্রতিটি সদস্যই দায়িত্ববােধে সচেতন থাকবেন। একে
অপরকে সৎ কাজে উপদেশ ও উৎসাহ দেবেন এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবেন।

অভিভাবক ইসলামী ভাবধারায় পরিবার পরিচালনা করবেন। বড়রা ছােটদের উত্তম
বিষয়গুলাে শিক্ষা দেবেন। জীবন চলার প্রতিটি ক্ষেত্রে পরস্পরে পূর্ণ সহযােগিতা
করবেন। 

এমনকি, মহান প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ইসলামসম্মত সকল কর্তব্য ও
দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করবেন।

৭) মুসলিম পরিবারে পুরুষ রাজা : 

ইসলামী পারিবারিক জীবনে পুরুষকে
পরিবারের কর্তা বা অভিভাবক নিযুক্ত করে তার উপর ভরণ-পােষণ, শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার
দায়-দায়িত্ব অর্পণ করেছে। মহান আল্লাহ তা'আলা বলেন, “পুরুষগণ নিজ নিজ স্ত্রীদের
কর্তা।” (আন-নিসা :৩৪)

 তাই স্ত্রী, সন্তান, দাসদাসী ও অন্যান্য অধীনস্ত লােকজন তাকে মেনে চলবে এবং তার আনুগত্য করবে যতক্ষণ পর্যন্ত ইসলামের বিধান অনুযায়ী চলতে। আদেশ করেন এবং তার আনুগত্য করা ইসলামের নির্দেশ।

স্ত্রী-স্বামীর অনুগত রাণী : 

মুসলিম পরিবারে স্বামী যেমন রাজা, স্ত্রী তেমনি অনুগত
স্বামীর সম্পদ, সন্তান-সন্ততি ও সংসার সম্পর্কে সচেতন থাকবেন । সর্বদা স্বামীর সাথে পরামর্শ করে কাজ করবেন। প্রতিটি কাজে স্বামীর আনুগত্য প্রকাশ করা প্রয়ােজন।

 এ প্রসঙ্গে মহানবী  (স:)বলেন, “স্ত্রী তার স্বামীর সংসার ও তার সন্তানাদির অভিভাবিক এবং
তিনি নিজের অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন।” (বুখারী ও মুসলিম)।

৯)সম্মান  ও স্নেহমমতার উৎস স্থল :

মুসলিম পরিবার দাবি করে ছােট-বড় নির্বীশেষে সকল সদস্যের প্রতি শ্রেনী মত সম্মান ও শ্রদ্ধা এবং আদর স্নেহ মমতামাখা আচরণ। বড়রা ছােটদের স্নেহের পরশ দিয়ে মানুষরূপে গড়ে তুলবে। 

আর  ছােটরা বড়দের সাথে সম্মান দিয়ে তাদের মেনে চলবে। মহানবী (স:)এ প্রসঙ্গে বলেন,
স্নেহ ও বড়দের সম্মান করে না সে আমাদের দলভুক্ত নয়।" (আবু দাউদ) কাজেই মুসলিম পরিবার ব্যক্তি-সম্মান ও স্নেহ মমতার উৎস স্হল।

১০) পারস্পরিক প্রতি ও ভালবাসা মাখা পরিবেশঃ

 মুসলিম পরিবারে পারস্পরিক স্নেহ-মমতার উৎস স্থল ।

প্রীতি-ভালবাসা, সহানুভূতি ও প্রেমই এনে দেয় স্বর্গসুখ । প্রিয়নবী (সঃ) বলেন, “তুমি মুমিনগণকে তাদের পরস্পরের প্রতি দয়া প্রদর্শন, ভালবাসা প্রদর্শন এবং পারস্পরিক

১১) আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা : 

আদর্শ পরিবার তার সদস্যদের আর্থ-সামাজিক ও
দাম্পত্য জীবনের নিরাপত্তা এনে দেয়। পরিবারবিহীন মহাশূন্যতা ও নিরাপত্তাহীনতা যা
মানুষকে নােঙরবিহীন নৌকার মতাে স্থিতিহীন করে দেয়। 
আল-কুরআনে এদিকে ইংগিত
করে ঘােষিত হয়েছে, “মুহাররাম মেয়েলােক ছাড়া অন্য সব মেয়েকে বিয়ে করা
তােমাদের জন্য বৈধ করা হয়েছে- এই উদ্দেশ্যে যে, তােমরা তােমাদের ধন-সম্পদের

বিনিময়ে তাদের লাভ করতে চাইবে নিজেদের চরিত্র দুর্জয় দূর্গের মত সুরক্ষিত রেখে
এবং বন্ধনহীন অবাধ যৌনাচার করা থেকে বিরত থেকে।” (আন-নিসা :২৪)

১২) কুরআন ও সুন্নাহর নীতির ভিত্তিতে গড়া : 

ইসলামী পরিবার কুরআন-সুন্নাহর নীতির ভিত্তিতে তথা ইসলামী জীবন বিধান অনুযায়ী গড়ে উঠবে। আল্লাহর বিধানের আওতায়ই স্বামী-স্ত্রী দাম্পত্য বন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং সন্তান জন্মদান করে। আর এই
বিধান মতই একে অন্যের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য পালন করে থাকে।

১৩) পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা :

 ইসলামী পরিবারের অন্যতমরূপ হলাে যে, ইসলামী
পরিবার পিতৃতান্ত্রিকভাবে গড়ে উঠে। এই পরিবারের কর্তা থাকেন পিতা। পিতার অনুপস্থিতিতে মাতা বা বড় ভাই পরিবারের দায়িত্ব পালন করেন। পিতা যেমন শ্রদ্ধেয়,
তেমনি দায়িত্বশীলও থাকেন। আল্লাহ তা'আলা বলেন, “পুরুষরা স্ত্রীদের পরিচালক-

একারণে যে, আল্লাহ তাদের মধ্যে এক দলকে অপর দলের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন ।
এজন্য যে পুরুষরা তাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে। কাজেই সতী নারীরা আনুগত্যপরায়ণ
হয়ে থাকে, পুরুষদের অনুপস্থিতিতে আল্লাহর তত্ত্বাবধানে ও পর্যবেক্ষণের অধীনে তাদের
অধিকার রক্ষা করে।" (আন্‌-নিসা :৩৪)

১৪) পরস্পরের পরিপূরকঃ

ইসলামী পরিবারে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের সহায়ক ও
সম্পূরক হয়ে থাকে। এরা একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। পরস্পরে সম্মিলিতভাবে
উন্নতি করে থাকে। একে অন্যের সম্মান ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। আল্লাহ তা'আলা বলেন।

لباس لكم وانتم يا له .

"স্ত্রীরা তােমাদের ভূষণ, আর তােমরা তাদের ভূষণ।” (আল-বাকারা :১৮৭)

১৫) বৈধ উপার্জন :

 ইসলামী পরিবারে সবাই উপার্জন করে কিনা পরিবারের কর্তা সেদিকে খেয়াল রাখেন। সদস্যদের হালাল উপায়ে উপার্জনের ব্যবস্থা করেন। হারামভাবে
উপার্জিত অর্থ দ্বারা যাতে ভরণ-পােষণের ব্যবস্থা না হয়, সে দিকে সতর্ক থাকেন।
 
ফলে পরিবার থেকেই উপার্জনের চেতনা জাগ্রত হয়। মহানবী (স.) বলেন, “হালাল উপার্জন
ফরযের পরেও একটি ফরয।” (বায়হাকী)

১৬) শান্তির নীড় : 

আদর্শ পরিবার একটি শান্তির নীড়। পরিবার একটি অনন্ত শান্তি নিকেতন, তৃপ্তি আর প্রশান্তির আবাসভূমি। আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ তা'আলা তােমাদের
পরস্পরের মধ্যে প্রেম, ভালবাসা ও করুণার সঞ্চার করে দিয়েছেন।” (আর রূম :২১)

“আল্লাহর নিদর্শনের মধ্যে একটি নিদর্শন এই যে, তিনি তােমাদের জন্য তােমাদের মধ্য
হতে তােমাদের সঙ্গিনীদের সৃজন করেছেন। যাতে তােমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক
এবং তিনি তােমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। “আল্লাহ তােমাদের জন্য তােমাদের ঘরকে শান্তি নিকেতন বানিয়েছেন।” (আন্ নাহল :৮০)


সুতরাং পরিবার হচ্ছে সমাজ জীবনের প্রথম ভিত্তি ও প্রাথমিক
প্রতিষ্ঠান। একটি আদর্শ সমাজ-সভ্যতা গড়ে তােলার জন্য সুষ্ঠু পূত-পবিত্র পারিবারিক জীবন।
অত্যন্ত জরুরি। একটি আদর্শ পরিবার গঠনে যেসব উপায় উপকরণ দরকার তার সব কিছুই ।
ইসলামে বিদ্যমান। তাই ইসলামী পরিবার প্রথা এক অনিবার্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা।

আরো পড়ুন, 

অন্যান্য সৃষ্টির মাঝে মানুষ শ্রেষ্ঠ কেন?



লেখকঃA.K

2 মন্তব্যসমূহ

নবীনতর পূর্বতন