বিদায় হজ্জের ভাষণ ও এর পটভূমি

বিদায় হজ্জের ভাষন |বিদায় হজের ভাষণের পটভূমি
বিদায় হজ্জ

আসসালামু আলাইকুম ওয়ারহমতুল্লাহ

 বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম 

 রাসূল সা: এর বিদায় হজ্বের ভাষণ

বিদায় হজ্জের ভাষন দশম হিজরি জিলহজ মাসের ৯ তারিখ আরাফাতের ময়দানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্জের ভাষন দেন।


বিদায় হজের ভাষণের পটভূমি 

 দশম হিজরি। জিলহজ মাস। ২৩ বছর আগে হেরাগুহায় জ্বলে উঠেছিল সত্যের আলো। আজ তা পূর্ণতায় উপনীত। এক কঠিন দায়িত্ব নিয়ে তিনি প্রেরিত হয়েছিলেন এ পৃথিবীতে। 


২৩ বছর কঠিন পরিশ্রম, সংগ্রাম, অপরিসীম কুরবানি ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল তাঁকে। তা আজ সমাপ্তির পথে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি প্রেরিত হয়েছিলেন মানুষের কাছে দূত হিসেবে তা আজ পূর্ণতার পথে। দীর্ঘ ২৩ বছর তিনি সাধনা করে একটি রাষ্ট্র গঠন করলেন। 


গঠন করলেন শোষণমুক্ত জুলুমহীন ন্যায়বিচারের সমাজ। গড়ে তুললেন তাওহিদভিত্তিক নব সভ্যতার এক নতুন জাতি মুসলিম উম্মাহ। তাই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সঙ্গী সাথীসহ হজ্বের উদ্দেশ্যে মক্কা নগরীতে গমন করেন এবং হজ্ব সম্পাদন করেন।


 আজ লাখো কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ইব্রাহীম আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ইসমাইল আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেখানে দাঁড়িয়ে কাবার প্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন সেখানে দাঁড়িয়ে এক মুসলিম উম্মাহ গঠনের জন্য মহান আল্লাহ তা’আলার দরবারে দোয়া করেছিলেন। 


বিদায় হজ্জের ভাষণ


সেই মুসলিম উম্মাহ আজ আরাফাতের ময়দানে সমবেত। আরাফাতের ময়দানে ৯ জিলহজ্ব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব মানুষের সামনে দাঁড়ালেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে আল্লাহ্ তা’আলার প্রশংসা করলেন। এরপর তিনি তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ পেশ করলেন।তিনি বললেন-


১. হে লোকসকল! আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোন। আমার মনে হচ্ছে এর পরে হজ্বে যোগ দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠবে না। [মাদনুল উম্মাল-তাবরী]


২. মূর্খ যুগের সমস্ত কুসংস্কার, সমস্ত অন্ধ বিশ্বাস এবং সকল প্রকারের অনাচার আজ আমার পায়ে দলিত মথিত হয়ে গেল। [বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ]


৩. মূর্খ যুগের সমস্ত রক্ত-প্রতিশোধ আজ থেকে রহিত। আমি সর্বপ্রথম ঘোষণা করছি, আমার গোত্রের প্রাপ্য সকল সুদ ও সকল প্রকার রক্তের দাবী আজ থেকে রহিত হয়ে গেল। [বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ] 


৪. একজনের অপরাধের জন্য অন্যকে দন্ড দেয়া যাবে না। অতএব, পিতার অপরাধের কারণে সন্তান আর সন্তানের অপরাধের কারণে পিতাকে দায়ী করা চলবে না। [ইবনে মাজাহ, তিরমিযী] 


৫. যদি কোনো হাবশী কৃতদাসকেও তোমাদের আমীর নিযুক্ত করা হয়, আর সে যদি আল্লাহর বিধান অনুযায়ী তোমাদের পরিচালনা করতে থাকে তবে তোমরা সর্বোত্র ভাবে তার আদেশ মেনে চলতে থাকবে। তার অবাধ্য হবে না। [মুসলিম] 


৬. সাবধান! ধর্ম সম্বন্ধে বাড়াবাড়ি করো না। এই অতিরিক্ততার ফলে তোমাদের পূর্বে বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। [ইবনে মাজাহ]
 

৭. মনে রেখো, তোমাদের সবাইকেই আল্লাহর সামনে উপস্থিত হতে হবে। তাঁর নিকট সকল কিছুর জবাবদিহি করতে হবে। সাবধান! তোমরা যেন আমার পরে ধর্মভ্রষ্ট হয়ে যেও না। কাফের হয়ে পরস্পরে রক্তপাতে লিপ্ত হয়ো না। [বুখারী] 


৮. দেখো, আজকের এই হজ্ব দিবস যেমন মহান, এই মাস যেমন মহিমাপূর্ণ, মক্কার এই হারাম (বাইতুল হারাম) যেমন পবিত্র- প্রত্যেক মুসলমানের ধন সম্পদ, মান-সম্ভ্রম এবং প্রত্যেক মুসলমানের রক্তবিন্দু তেমন তোমাদের কাছে মহান, তেমন পবিত্র। পূর্বোক্ত বিষয়গুলোর অবমাননা করা যেমন তোমরা হারাম মনে করো, ঠিক তেমনি কোনো মুসলমানের সম্পত্তি, সম্মান ও প্রাণের ক্ষতি করা তোমাদের জন্য হারাম। [বুখারী, মুসলিম, তাবরী]


৯. এক দেশের লোকের অন্য দেশবাসীর ওপর প্রাধান্য পাবার কোনই কারণ নেই। মানুষ সবাই আদম আ. থেকে আর আদম আ. মাটি থেকে। [একদুল ফরিদ] 


১০. জেনে রাখো, এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই। আর সকল মুসলমানকে নিয়ে একটি অবিচ্ছেদ্য ভাতৃসমাজ। [হাকিম মুস্তাদরাক, তাবরী] 


১১. হে লোকসকল শোন! আমার পরে কোনো নবী নেই। তোমাদের পর আর কোনো উম্মত নেই। আমি যা বলছি মনোযোগ দিয়ে শোন, এই বছরের পর তোমরা হয়তো আর সাক্ষাৎ পাবে না। এলেম উঠে যাবার আগে আমার কাছ থেকে শিখে নাও। [কানজুল উম্মাল, মুসনাদে আবি উমামা, রিহলাতে মুস্তফা] 


১২. চারটি কথা, হ্যা! এই চারটি কথা বিশেষভাবে মনে রেখো- শিরক করো না, অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করো না, পরস্ত্রী অপহরণ করো না, ব্যাভিচার করো না। [মুসনাদে সালমা ইবনে কায়েস, রিহলাতে মুস্তফা] 


১৩. হে লোকসকল শোন! গ্রহণ করো, গ্রহণ করে জীবন লাভ করো। সাবধান! কোনো মানুষের উপর অত্যাচার করো না! অত্যাচার করো না!! অত্যাচার করো না!!! সাবধান, কারো অসম্মতিতে তার সামান্য সম্পদও নিও না। [মুসনাদে রক্কাশী, মুসনাদে সালমা ইবনে কায়েস] 


১৪. আমি তোমদের কাছে দুটি বিষয় রেখে যাচ্ছি, তা দৃঢ়তার সাথে ধরে রাখলে তোমরা সামান্যও পথভ্রষ্ট হবে না। তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব (আল-কুরআন) ও তাঁর রাসূলের আদর্শ (হাদীস)। [বুখারী, মুসলিম]


১৫. শয়তান নিরাশ হয়েছে, সে আর কখনো তোমাদের কাছে পাত্তা পাবে না। কিন্তু সাবধান! অনেক বিষয়কে তোমরা ক্ষুদ্র বলে মনে করো, অথচ শয়তান সে বিষয় দিয়েই তোমাদের সর্বনাশ করে থাকে। ঐ বিষয়গুলো সম্বন্ধে খুব সতর্ক থাকবে। [ইবনে মাজাহ, তিরমিযী]


১৬. নারীদের ব্যাপারে আমি তোমাদের সতর্ক করে দিচ্ছি, তাদের প্রতি কখনো নির্মম হয়ো না। এক্ষেত্রে আল্লাহর ভয় করো। নিশ্চয়ই তোমরা তাদেরকে আল্লাহর জামিনে গ্রহণ করেছ এবং তাঁরই কালাম দ্বারা তোমাদের দাম্পত্য স্বত্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মনে রেখো, তোমাদের স্ত্রীদের ওপর তোমাদের যেমন দাবী ও অধিকার আছে, তোমাদের ওপরও তাদের তেমন দাবী ও অধিকার আছে। তোমরা পরস্পর পরস্পরকে নারীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করবে। মনে রেখো, এই অবলাদের বল তোমরাই, এদের একমাত্র সহায় তোমরাই। [বুখারী, মুসলিম, তাবরী]


১৭. দাস দাসীদের নির্যাতন করো না। তাদের প্রতি নির্মম হয়ো না। শোন, ইসলামের আদেশ তোমরা যা খাবে তাদেরকেও তাই খাওয়াতে হবে, তোমরা যা পরবে তাদেরকেও তাই পরাতে হবে। কোনো প্রকার তারতম্য চলবে না। [তাবকাত]


১৮. যে ব্যক্তি নিজের বংশের পরিবর্তে নিজেকে অন্য বংশের বলে পরিচয় দেয়, তার উপর আল্লাহ পাকের, ফেরেশতাদের ও সমগ্র মানবজাতির অভিশাপ। [মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ]


১৯. যারা উপস্থিত আছো, তারা অনুপস্থিতদেরকে আমার এই সকল পয়গাম পৌছে দেবে। হতে পারে, উপস্থিত কিছু লোক থেকে অনুপস্থিত কিছু লোক এর দ্বারা বেশি লাভবান হবে। [বুখারী] 


 মহানবী সা. ভাষণ শেষ করলেন এবং তাঁর চেহারা মোবারক উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি করুণ স্বরে করুণভাবে আকাশ পানে তাকালেন এবং তিনি বললেন, ‘হে মহান প্রভু! হে পরওয়ার দিগার! আমি কি তোমার দ্বীনের দাওয়াত পরিপূর্ণভাবে মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি।


 তখন উপস্থিত জনতা সবাই সম্মিলিতভাবে বললেন, নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর দ্বীন পরিপূর্ণভাবে পৌঁছাতে পেরেছেন। তখন তিনি আবার বললেন, হে প্রভু! আপনি শুনুন, আপনি সাক্ষী থাকুন, এরা বলেছে আমি আপনার দ্বীন লোকদের নিকট পৌঁছাতে পেরেছি।


 আমি আমার কর্তব্য পালন করতে পেরেছি। ভাবের অতিশয্যে নবী নীরব হলেন। জান্নাতি নূরে তাঁর চেহারা আলোকদীপ্ত হয়ে উঠল। এই মুহূর্তে কুরআনের শেষ আয়াতটি নাজিল হয়। 


 ’আজকের এই দিনে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করে দিলাম। তোমাদের ওপর আমার নিয়ামত পূর্ণ করে দিলাম। ইসলামকেই তোমাদের ওপর দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।’ [সূরা মায়েদাহ, আয়াত ৩] 


হযরত রাসূল সা. কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। জনতা নীরব। কিছুক্ষণ পর হযরত রাসূল সা. জনতার দিকে তাকালেন এবং করুণ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন বিদায় বন্ধুগণ, বিদায়। [বুখারী] "
 

লেখা ঃ সংগৃহীত

আরো পড়ুন,

সুরা ফালাক ও সুরা নাস অবতীর্ণ হওয়ার কারণ কি? কোন ঘটানার পরিপেক্ষিতে নাজিল হয়?

3 মন্তব্যসমূহ

নবীনতর পূর্বতন